“সুরুজ, অই সুরুজ! উইঠা পড় বাজান। বিয়ান হইসে।” সকাল সকাল নিজের ছেলেকে ঘুম থেকে উঠার তাগাদা দেন গফুর মিয়া।
“উঠতাসি বাজান। প্রইত্যেকদিন এতো বিয়ানে তুইলা দেও ক্যান বাজান? আর কতক্ষণ ঘুমাইতে পারতাম।” ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলে গফুর মিয়ার কিশোর ছেলে সুরুজ।
“বিয়ানে উডন ভালারে বাজান। সকালে শোয় সকালে উঠে, তার কড়ি না বৈদ্যে লোটে। বুঝলি বাজান?
উইডা পর। আইজকা ম্যালা কাম।” ছেলেকে বলেন গফুর মিয়া। সুরুজ ঘুম থেকে উঠলে পেটে কিছু দানাপানি ফেলে হালের বলদ, লাঙ্গল-মই নিয়ে বাপবেটা চললো ক্ষেতের দিকে। জমিনে পৌঁছে গফুর মিয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে কি জানি হিসাব করে বলদে লাঙ্গল জুড়তে শুরু করলেন। সুরুজ কিছুটা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ
উইডা পর। আইজকা ম্যালা কাম।” ছেলেকে বলেন গফুর মিয়া। সুরুজ ঘুম থেকে উঠলে পেটে কিছু দানাপানি ফেলে হালের বলদ, লাঙ্গল-মই নিয়ে বাপবেটা চললো ক্ষেতের দিকে। জমিনে পৌঁছে গফুর মিয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে কি জানি হিসাব করে বলদে লাঙ্গল জুড়তে শুরু করলেন। সুরুজ কিছুটা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলোঃ
> বাজান, তুমি এতোক্ষণ ধইরা কি হিসাব করলা?
- পূবদিক থেইকা লাঙ্গল চালাইতে হয়। এইডা নিয়ম। বুঝলি বাজান? হেইডাই এতোক্ষণ হিসাব করলাম।
“মাঠে গিয়া আগে দিক নিরূপণ
পূবদিক হইতে কর হালের চলন।”
> অ, আইচ্ছা। কিয়ের চাষ করবা বাজান?
- আউশ ধানের চাষ করুম।
> কখন লাগাইবা ধান?
- এইতো, আষাঢ়-শাওন মাসে লাগামু।
“আষাঢ়ে পনের শ্রাবণে পুরো
ধান লাগাও যত পারো।”
> আইচ্ছা বাজান, কতদিনে ধান হইব?
- তিনমাস লাগবো বাজান।
“আউশ ধানের চাষ
লাগে তিনমাস।”
> বাজান, তুমি যে কথায় কথায় এতো সোন্দর সোন্দর ছড়া কইতাসো এইগুলান কি? কোত্থেইকা শিখসো?
- এইগুলান হইলো গিয়া খনার বচন। এইডিতো হগলেই জানে। আমরা হাইল্লা চাষারাতো এইগুলান হিসাব কইরাই কামে নামি। তুইও বড় হইতে হইতে শিখা ফেলবি।
> খনার বচন! খনা আবার ক্যাডা?
সুরুজের মতো আমাদেরো মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, কে এই খনা? গ্রামবাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে কেনইবা তার এতো সর্বব্যাপী প্রভাব? চলুন জেনে আসি খনা সম্পর্কে কিছু কথা।
মনে করা হয় যে, খনা ছিলেন একজন নারী জ্যোতিষী ও কবি। খনা সম্পর্কে বহুত রকমের কাহিনী-কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এইসব কাহিনীমতে, খনা ছিলেন এক প্রাচীন বিদুষী জ্যোতিষী-গণিতজ্ঞ, যিনি ছিলেন আরেক বিখ্যাত জ্যোতিষী মিহিরের স্ত্রী আর বরাহের পূত্রবধূ। তাঁর এই খনা নামকরণের ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। বাংলায় প্রচলিত কিংবদন্তিমতে ‘খনা’ নামটা এসেছে ‘ক্ষণা’ থেকে অর্থাৎ ‘শুভক্ষণে জন্ম যার’। আবার ওড়িয়া ভাষায় ‘খনা’ বা ‘খোনা’ অর্থ হল ‘বোবা’। প্রচলিত কাহিনীমতে খনার জিভ কেটে দিয়ে তাকে বোবা বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। খনার ব্যাপারে ঐতিহাসিক কোনো দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া যায় নাই। তাই তাঁর সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদেরকে কেবলই লোককথার উপরে নির্ভর করতে হয়। এমনই এক লোককথা মোতাবেক, খনার জন্ম হয় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার বারাসত থানার দেউলি গ্রামে। তার পিতার নাম ছিল অটনাচার্য। খনার পরিচয় সম্পর্কে তাঁর এক বচনে পাওয়া যায়ঃ
“আমি অটনাচার্যের বেটি
গণতে গাঁথতে কারে বা আঁটি।”
অন্য এক কিংবদন্তী মতে খনা ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা। কথিত আছে, উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার বিখ্যাত জ্যোতিষী বরাহ নিজের সদ্যোজাত পুত্র মিহিরের কোষ্ঠী গণনা করে দেখেন যে তাঁর পুত্রের আয়ু মাত্র এক বছর। তিনি শিশুপুত্র মিহিরকে একটা পাত্রে করে জলে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটা ভাসতে ভাসতে সিংহলে গিয়ে ঠেকলে সিংহলরাজ তাকে উদ্ধার করেন এবং লালনপালন করে বড় করেন। পরে নিজের মেয়ে লীলাবতীর(খনা) সাথে মিহিরের বিয়ে দেন। কাছাকাছি ধরণের আরেকটি কাহিনী হলো একদল রাক্ষস সিংহলের রাজারাণীকে মেরে ফেলে। কিন্তু রাজকন্যা রাক্ষসদের অধীনেই লালিতপালিত হয়। এই রাক্ষসরাই আবার জলে ভেসে আসা বরাহপুত্র মিহিরকে লালনপালন করে এবং লীলাবতীর সাথে মিহিরের বিয়ে দেয়। পরে তারা মিহিরের পিতা বরাহের কাছে চলে যায়। এরপরের কাহিনী প্রায় সব কিংবন্তীতেই এক। লীলাবতী এক ঘটনাচক্রে রাজা বিক্রমাদিত্যের খাস অনুগ্রহ লাভ করেন এবং শ্বশুরের স্থলে রাজসভায় অভিষিক্ত হন। এতে করে শ্বশুর বরাহ পুত্রবধূর উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে পিতার প্ররোচনায় মিহির নিজের স্ত্রীর জিভ কেটে নেন এবং লীলাবতী ‘খোনা’ বা ‘বোবা’ হয়ে যায়। হয়তো রক্তক্ষরণেই পরে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কথামালা এক অমোঘ অলিখিত সংবিধান হিসেবে অমর হয়ে থাকে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। এক কাহিনী মোতাবেক, খনার জিভের কাটা অংশ টিকটিকি খেয়ে ফেলে এবং সেকারণেই আজো কোনো সঠিক কথা বললে টিকটিকি “ঠিক ঠিক ঠিক” বলে সায় দেয়।
খনার সময়কাল সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানা যায় না। খনার বচনগুলোর ভাষারূপ দেখে এগুলো প্রায় চারশো বছরের পুরনো বলে মনে হয়। তবে হতে পারে এগুলো আজ আমরা যে রূপে দেখতে পাচ্ছি মৌখিকভাবে হয়তো অন্য কোন রূপে বা ভিন্ন কোন ভাষায় রচিত হয়েছিল। পরবর্তীতে কালপরিক্রমায় এগুলোর আজকের চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এদিক হতে চিন্তা করলে খনার সময়কাল আরো বহু পূর্বে ঐতিহাসিক চরিত্র বরাহের সময়কার(৫০৫-৫৮৭খ্রিস্¬টাব্দ) হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খনার বচনগুলো প্রায় কাছাকাছি, কিছুটা ভিন্নরূপে অথবা ভিন্ন ভাষায় বাংলা, বিহার উড়িষ্যা, আসাম থেকে শুরু করে নেপাল কিংবা কেরালার গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সমাজেও বহুলভাবে প্রচলিত আছে। খনার বচনগুলো প্রকৃতপক্ষে কেবল একজনের মুখের কথাই নয়। হয়তোবা খনাই এধরণের প্রবচনের ধারা উদ্ভব ঘটিয়েছিলেন। পরবর্তীতে নানাজনের নানান উপদেশবাক্য এতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এগুলো আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের স্বতঃ স্ফূর্ত সাহিত্য বলা চলে। খনার বচনগুলোতে কিভাবে কৃষিকাজে সঠিক তরিকা অবলম্বনে অধিক ফলন পাওয়া যায়, ফসলের মড়ক হতে রক্ষা পাওয়া যায়, বন্যা বা খরার ব্যাপারে পূর্বাভাস ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে করে বোঝা যায় খনার বচনগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য হলো কৃষিকাজের উন্নতি।
শুভ-অশুভক্ষণ, তারার সঠিক অবস্থান ইত্যাদির কথা বাদ দিলে খনার বচনে বিধৃত কৃষি সম্পর্কিত বয়ানগুলো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ। এগুলো গ্রামবাংলার কৃষকসমাজের শত শত বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন,“আমি মনে করি একজন কৃষিবিজ্ঞানী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে লেখাপড়া শেষ করে তাত্ত্বিক যেসব কথা বলবেন তার চেয়ে একজন কৃষক বেশি বাস্তব কথা বলবেন। কৃষকদের এই জ্ঞানের পেছনে খনার বচন বলে পরিচিত যে জ্ঞানের সংকলন সেটার একটা প্রভাব আছে।”
আজো গ্রামেগঞ্জে সরেজমিনে যদি খোঁজখবর নেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে উত্তরাঞ্চলের রংপুর হোক কিংবা দক্ষিণাঞ্চলের চট্টগ্রাম সব জায়গায় গফুর মিয়ার মতো প্রান্তিক কৃষকেরা এখনো খনার বচনকেই কৃষিকাজের মৌলিক নির্দেশনামা মনে করেন। তাদের অনুসৃত পদ্ধতি একেবারেই প্রাকৃতিক। প্রকৃতির সহজ স্বাভাবিক নিয়মকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় খনার বচন তারই ছন্দোবদ্ধ খতিয়ান। হাজার হাজার বছর ধরে প্রকৃতির সাথে মানুষের যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান তারই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক প্রকাশ এই খনার বচন। অথচ আজ উন্নত প্রযুক্তির নামে ক্ষতিকর রাসায়নিক সার, কীটনাশক কিংবা সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানীর তৈরী জেনেটিক্যালী মডিফাইড অরগানিজম(জিএমও) ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃতিকে একরকম ঘাড় চেপে ধরে উৎপাদন বাড়িয়ে ফায়দা লোটার হিড়িক পড়ে গিয়েছে। ফলে একদিকে যেমন প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বিচ্যুত হয়ে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অন্যদিকে অধিক লাভবান হতে গিয়ে মানুষ ডেকে আনছে ক্যান্সারের মতো আরো অনেক মারাত্মক ব্যাধিতে নিজেদের অকাল মৃত্যু। এই ভয়াবহ অবস্থা মোকাবিলার উপায় হলো খনার বচনের মতো লোকজ ধারায় আবার আবহমান বাংলার চিরায়ত প্রাকৃতিক কৃষির সুদিন ফিরিয়ে আনার যথাসাধ্য চেষ্টা করা।
খনার বচনে কৃষি, পশুপালন ছাড়াও স্বাস্থ্যগত উন্নতি, গৃহ ও সংসার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারেও মূল্যবান উপদেশনামা পাওয়া যায়। তবে একটা ব্যাপার অত্যন্ত লক্ষণীয় যে, অতি পুরাতন লোকজ বচন হওয়া সত্ত্বেও খনার বচনে ঝাড়ফুঁক, তুকতাক, তাবিজকবচ ইত্যাদি কুসংস্কারের স্থান একেবারেই নেই। বরং পরিমিত খাদ্যাভ্যাস কিংবা খোলামেলা বাতাস বা স্বাস্থ্যসম্মত ঘর ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে এসব বচনে। তবে রোগের চিকিৎসা নয় বরং রোগ প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার পদ্ধতিরই বয়ান পাওয়া যায় খনার বচনে। যেমনঃ
“নিত্যি নিত্যি ফল খাও/বদ্যি বাড়ি নাহি যাও।”
কিংবা “নিম নিসিন্দা যথা/মানুষ কি মরে তথা?”
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও খনার প্রায় বচনই স্বাস্থ্যসুরক্ষায় পালনীয় এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অনেকাংশেই সঠিক। খনার বচনগুলো সার্বিকভাবে লক্ষ্য করলে আরেকটি চমৎকার ব্যাপার চোখে পড়ে। সেটি হলো, খনার বচনগুলো একেবারেই নারীবিদ্বেষবিবর্জিত।¬ কোনো বচনেই কোনোভাবে নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়নি। বাংলার প্রাচীন গ্রাম্য কৃষিভিত্তিক সমাজ যে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল এটি হয়তো তারই পরিচায়ক।
কিংবদন্তীমতে খনা হয়তো প্রাচীন কোনো বিদুষী নারীকবি ছিলেন। কিন্তু খনার বচনগুলো আসলে আমাদেরই পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া উপদেশনামা যা তাঁদের শত শত বছরের লব্ধ অভিজ্ঞতার সাহিত্যরূপ। আমাদের পিতা, পিতামহরাও এই খনার বচনকে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করতেন। আজ আমরা প্রযুক্তির গোলকধাঁধায় পড়ে আমাদের একান্তই নিজস্ব লোকজ এই ধারাকে ভুলে যেতে বসেছি, যা একেবারেই কাম্য নয়। বাংলার হাওয়া-মাটি-জলে গড়ে ওঠা এই লোকঐতিহ্যের সংরক্ষণ, পরিচর্যা, চর্চা আমাদেরই দায়িত্ব। নাহলে আধুনিকতার অতলে হয়তো হারিয়ে যাবে অমূল্য এই লোকজ সাহিত্য।
হিংসে হয়।
উত্তরমুছুন