রবিবার, ৩ মে, ২০২০

স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা - আকবর হোসেন রবিন


কিছুক্ষণ আগে আমার জন্ম হয়েছে।  জন্মের পর প্রথম যে শব্দ গুলো কানের পর্দাকে কম্পিত করেছে,  তা আমার মায়ের কন্ঠ থেকে আসা। তটস্থ কন্ঠ।  পাশের বাসার অনামিকা গলায় ফাঁস দিয়েছে।  তাদের বাসার সামনে ভোর থেকে ভিড় লেগে আছে।  এলাকার ছোটোবড়ো সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।  পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে।  হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে এসে পৌঁছবে।  বাহিরে এতকিছু হয়ে গেল, অথচ আমার হুঁশ নেই।
  অবশ্য এতে আমার কোন দোষ নেই।  আজ আমার জন্মাতে একটু বেশিই বিলম্ব হয়েছে।


এখন যেটা করতে হবে,  ফ্রেশ হয়ে ভার্সিটিতে যেতে হবে।  ম্যাম বলে দিয়েছে আজ ক্লাসে উপস্থিত না থাকলে টেন মার্কস কেটে নিবে! যদিও উনি এমন হুমকি প্রায় দিয়ে থাকে।  তারপরেও আমাকে সিরিয়াস হতে হবে,  ক্লাসে যেতে হবে।  এমনিতে মিডটার্মে নাম্বার কম পেয়েছি। যদি তার উপরে আরও দশ নাম্বার কেটে নেয়,  তাহলে মারা খাবো।

আমি বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তার উৎসুক লোকদের পাশ কাটিয়ে হাঁটতে লাগলাম।  এই মুহূর্তে আমার মধ্যে কোন কৌতুহল নেই।  সত্যিই কোন কৌতুহল নেই।  অনামিকাকে কখনও এইভাবে দেখিনি,  এখনও দেখতে পারবো না।  আমার মাথায় এখন একটাই চিন্তা,  ঠিক সময়ে ক্লাসে পৌঁছতে হবে।  অন্যথায় ম্যাম ক্লাসে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখবে।  সত্যি বলছি,  দেরি হলে ম্যাম ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখবে।
আমি টেম্পুতে উঠলাম।  বাসে চড়লাম।  আমার কপাল ভালো,  ঠিক সময়ে ভার্সিটিতে এসে পোঁছলাম।  এরপর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসে ঢুকে কিছুক্ষণ ঝিমুলাম।  তারপর বের হয়ে গেলাম।  বের হতেই সাফা ভাইয়ের সাথে দেখা।  সাফা ভাই ভার্সিটিতে আমার থেকে দুই ব্যাচ সিনিয়র। আইডি কার্ড গলা থেকে নামালে এর চেয়ে বেশি। উনি কথাবার্তায় বেশ পটু, তবে জ্ঞানের গভীরতা তার চেয়ে বেশি।  এইতো আমাকে দেখেই বলে উঠলো, ‘রবিন! আমাকে তো আর পাবা না।’
‘কেন?  মরেটরে যাবেন না-কি?’
‘ধুরমিয়া! কি বলো এসব! মরে যাবার বিষয়টা আলাদা করে নিয়ে আসো কেন! আমরা তো এমনিতেই প্রতিদিন মরে যাই, আবার জন্মাই।’
‘তাহলে কাহিনী কি?’
‘শোন, আমার তো অনার্স লাইফ শেষ পর্যায়ে, তাই প্লান করলাম এখানে পড়া শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে সুইজারল্যান্ড চলে যাবো। ’
‘বাহ্ ভালোতো।  তবে এত দেশ থাকতে সুইজারল্যান্ড কেন?’
‘বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিতে।  এই দেশে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের খুব অভাব।  খুব বেশিই অভাব। ’
‘অক্সিজেন নিতে সুইজারল্যান্ড যেতে হয় নাকি! আপনি গ্রামে যান, পাহাড়ে যান। ’
‘গ্রাম! সেটা আর আছে কই?  শহরের হাওয়া লেগে দিনদিন সব বদলে যাচ্ছে।  প্রতিদিন তৈরী হচ্ছে ইট,  বালি, সিমেন্টের তৈরী দালান কোটা। আরেকটা কী বললে? ও, পাহাড়।  সেই তো পুঁজিবাদীদের হাতে।
প্রতিনিয়ত চলছে পর্যটনের নামে পাহাড়ি উচ্ছেদ।  আর শহুরে কীটদের জন্য তৈরি হচ্ছে,  হোটেল মোটেল পাঁচতারা। ’

আমাদের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথোপকথন চললো।  তারপর হঠাৎ পিছন থেকে আরিয়ান ভাইয়ের কন্ঠ ভেসে এলোঃ ‘হে কমরেড  রবিন,  কমরেড সাফা,  কেমন আছো? ’
জবাবটা সাফা ভাই দিলেন, ‘এই মুহূর্তে খুব হতাশায় আছি। ’
আরিয়ান ভাই মুখে হাসি টেনে বললেন, ‘তাহলে আমি এখন আসি,  এমনিতে এতক্ষণ ক্লাসে হতাশায় ছিলাম।  নতুন করে তোমাদের হতাশায় ডুব না-ই দিলাম।’
আরিয়ান ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ কার্যালয়ে। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের ‘দেশ বিদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা’  শীর্ষক আলোচনা সভায়।  এরপর থেকে যখনই দেখা হয়, আরিয়ান ভাই আমাদের কমরেড বলে ডাকে।  যদিও সেদিনের পর থেকে আমরা কেউই আর বাসদের কোন সেমিনারে যাইনি।  যাওয়ার ইচ্ছেও জাগেনি।  ওরা খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে,  রেল ইস্টিশনের সামনে, পত্রপত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের টকশোতে ঘুরেফিরে একই কথা বলে। সেই মার্কসবাদ,  সেই লেলিনবাদ। আর কমরেড রাজেকুজ্জামান রতনের মুখস্ত করা সব পরিসংখ্যান। আচ্ছা,  একই কথা কয়বার শুনা যায়?

সাফা ভাই বললেন, ‘বাসায় চলে যাবো।  তুমি যাবে?  নাকি কিছুক্ষণ থাকবে?’
আমি বললাম, ‘কিছুক্ষণ থাকবো।  শুভ্রদা, সাঈদি, ফারদিন, বোরহানদের সাথে আড্ডা দিবো। ’
সাঈদী,  ফারদিন,  শুভ্রদা কবিতা নিয়ে আসবে।  বোরহান সেগুলো আওড়াবে।  আর বলবে, কবিতাখানা সরস হইছে।  শুভ্রদা বলবে, সাধু সাধু।! সাঈদী তার ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে পাঠ করবে শায়েরী।  শুভ্রদা বাহ্ বাহ্ বলে গলা ছেড়ে গান ধরবে।  ফারদিন মুহূর্তটারে ক্যামেরাবন্দী করবে।  আর আমি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করবো।  তারপর বাসায় ফিরবো।  বাসায় ফিরে প্রথমে ছাদে উঠবো।
শুধু আজ না,  রোজ এই সময়টায় আমি ছাদে উঠি।  লুকিয়ে লুকিয়ে অনামিকাকে দেখতে। বাতাসে উড়তে থাকা চুলের সৌন্দর্য দেখতে। অনামিকার হাঁটা দেখতে।  ঠোঁটের নাড়াচাড়া দেখতে।  অনামিকা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে, কথা বলে।  আর গোধুলিলগ্নে দিনের শেষ আলো গায়ে মেখে ছাদ ছেড়ে বাসায় ফিরে।

আমি এসব আড়াল থেকে দেখি।  আজও দেখতে পাচ্ছি।  পাশের ছাদে অনামিকা হাঁটছে।  পরনে আকাশী রঙের শাড়ি।  অনামিকাকে এর আগে কখনও শাড়ি পড়তে দেখিনাই।  এই রঙের ড্রেসও আজই প্রথম।  আচ্ছা অনামিকা আজ হঠাৎ আকাশী রঙ গায়ে জড়ালো কেন?  তার কি খুব আকাশ হতে ইচ্ছে করছিল?

কিছু প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতে কখন যে দিনের আলো বিশ্রামে গেল টেরও পাইনি।  এখন আর পাশের বাড়ির ছাদ দেখা যাচ্ছেনা।  চারদিকে শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার।  অনামিকা কখন, কোথায় যে চলে গেল তাও বুঝতে পারলাম না।  এমন অবস্থায় মন ভারি করে ঘরে আসলাম। এসেই হাতে চা নিয়ে বসলাম।  টিভি ছেড়ে দেখলাম সিরিয়া।  বিধ্বস্ত সিরিয়া। কয়েকটা শিশু মাটিতে শুয়ে আছে।  ওদের দেখে আমিও শুয়ে পড়লাম,  তবে মাটিতে নয়, বিছানায়।  চোখগুলো নিভু নিভু হচ্ছে এমন সময় অনামিকা এসে আমার পাশে বসলো।  কপালে হাত বুলিয়ে একটা চুমু আঁকলো।  আর আমি মরে গেলাম।  
তাতে কি! ভালোবাসা তো পেলাম।

x

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

অবশেষে চলে এলো হুলুস্থুল (অ)সুখের নিদানকাল সংখ্যা!

কথা ছিলো ঈদের আগেই আসবে নিদানকাল সংখ্যা। কিন্তু ঈদের আগমুহুর্তে নতুন কিছু লেখা আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই একটু দেরি হলেও ঈদের পরেই প্রকাশ করা হ...